নিস্তব্ধতার আর্তনাদ

গভীর রাতের নিস্তব্ধতা, সঙ্গে ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক। বারান্দার ইজিচেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে আছি। হাতে চায়ের কাপ। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, জানি। কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। শরীরটা বড় দুর্বল লাগছে আজ। মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে। কপালে ভেজা বাষ্পের মতন জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘরের ভেতরের হালকা হলুদ আলোর আভা এসে পড়েছে বারান্দার মেঝেতে। সেখানে একটা মরা মথ পড়ে আছে, পাখাগুলো ছড়ানো। যেন মৃত্যুর পরেও উড়ে যাওয়ার শেষ চেষ্টা করছে।
ভেতরের ঘর থেকে খুকখুক কাশির শব্দ আসছে। আমার স্ত্রী, রাহেলা। ক্যানসারের শেষ পর্যায়। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, আর বেশিদিন নেই। প্রতিটা মুহূর্তে ওর কষ্ট দেখে আমার বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যায়। মনে হয়, ইসস, যদি ওর সব কষ্ট আমি নিজে নিতে পারতাম!
রাহেলা আবার কাশল। এবার একটু জোরে। শব্দটা যেন বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে।

আমার চোখ বন্ধ হয়ে এল। নাহ, আর পারছি না। আর দেখতে পারছি না ওর কষ্ট। ওর কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না। চায়ের কাপটা ইজিচেয়ারের পাশে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল পাখির কিচিরমিচির শব্দে। আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। জানালার পর্দাগুলো সরানো। মনে হলো, আজ অনেকদিন পর ভালো ঘুম হলো। বুকটা হালকা লাগছে। রাহেলার কাশিটাও শুনছি না আর। হয়তো ঘুমোচ্ছে। ক্যানসারের রোগীরা দুর্বল থাকে, ঘুম দরকার।
আমি উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। রাহেলার জন্য চা বানাব। ও কড়া লিকার চা ভালোবাসে। চিনি ছাড়া। ফ্রিজের গায়ে লাগানো রাহেলা আর আমার পুরোনো একটা ছবি। বিয়ের প্রথম দিকের ছবি। রাহেলাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! হাসছে প্রাণ খুলে। কিন্তু এখন ওর মুখে সে হাসি নেই। সারাক্ষণ যন্ত্রণায় মুখ কুচকে থাকে, চোখ দিয়ে আপন মনে হল পরে। ফ্রিজের গায়ে লাগানো ছবিটা দেখতে দেখতে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম বুকের ভেতর। হঠাৎ চোখ পড়ল রান্নাঘরের টেবিলে রাখা একটা সেলাই করা ন্যাপকিনের ওপর। রাহেলার হাতের কাজ। এখনও ও নিজের হাতে সেলাই করে। ওর হাত কাঁপে, সুঁই ফোটাতে কষ্ট হয়। তবু সেলাই ছাড়তে পারে না। অদ্ভুত লাগে আমার। এই ক্যানসার শরীর নিয়েও ওর এত শক্তি আসে কোথা থেকে! আমি হাসলাম।
চা বানিয়ে ঘরে ফিরে দেখি রাহেলা বিছানায় নেই। ভাবলাম, হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। বেডরুমে গিয়ে দেখি, ওর মাথার কাছের টেবিলে একটা খোলা বই রাখা। ‘শেষের কবিতা’। রাহেলা বারবার পড়ে এই বইটা।
বইয়ের পাতার ভাঁজে একটা শুকনো গোলাপের পাপড়ি।

চিনি ছাড়া। ফ্রিজের গায়ে লাগানো রাহেলা আর আমার পুরোনো একটা ছবি। বিয়ের প্রথম দিকের ছবি। রাহেলাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! হাসছে প্রাণ খুলে। কিন্তু এখন ওর মুখে সে হাসি নেই। সারাক্ষণ যন্ত্রণায় মুখ কুচকে থাকে, চোখ দিয়ে আপন মনে হল পরে। ফ্রিজের গায়ে লাগানো ছবিটা দেখতে দেখতে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম বুকের ভেতর। হঠাৎ চোখ পড়ল রান্নাঘরের টেবিলে রাখা একটা সেলাই করা ন্যাপকিনের ওপর। রাহেলার হাতের কাজ। এখনও ও নিজের হাতে সেলাই করে। ওর হাত কাঁপে, সুঁই ফোটাতে কষ্ট হয়। তবু সেলাই ছাড়তে পারে না। অদ্ভুত লাগে আমার। এই ক্যানসার শরীর নিয়েও ওর এত শক্তি আসে কোথা থেকে! আমি হাসলাম।
চা বানিয়ে ঘরে ফিরে দেখি রাহেলা বিছানায় নেই। ভাবলাম, হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। বেডরুমে গিয়ে দেখি, ওর মাথার কাছের টেবিলে একটা খোলা বই রাখা। ‘শেষের কবিতা’। রাহেলা বারবার পড়ে এই বইটা। বইয়ের পাতার ভাঁজে একটা শুকনো গোলাপের পাপড়ি। কাল রাতেও এই বইটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়েছিল ও। আমি চা-টা টেবিলে রেখে বারান্দায় গিয়ে বসলাম।
একটু পর রাহেলা এসে আমার পাশে দাঁড়াল। ওর পরনে হালকা নীল রঙের শাড়ি। চুলে একটা গোলাপ গুঁজেছে। মুখে হালকা হাসি। আমি অবাক হলাম। “তুমি কখন উঠলে? আমি তো চা বানাচ্ছিলাম।”
রাহেলা হাসল, “অনেকক্ষণ। তুমি ঘুমোচ্ছিলে, তাই ডাকিনি।”
আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। রাহেলা আজকাল এত সকালে ওঠে না। ওর শরীর এত দুর্বল যে হাঁটাচলা করতেও কষ্ট হয়। আর আজ চুলে গোলাপ! তাও এত সতেজ একটা গোলাপ। বাগানে তো এখন কোনো গোলাপ ফোটার কথা না। আমি ওর হাত ধরলাম। হাতটা বরফের মতো ঠান্ডা। আমি চমকে উঠলাম। “তোমার শরীর এত ঠান্ডা কেন রাহেলা? জ্বর আসছে নাকি?”
রাহেলা আমার দিকে তাকাল। ওর চোখে কেমন একটা শূন্যতা। “না তো। ভালোই তো লাগছে।”
এরপর দিনগুলো কেমন অদ্ভুতভাবে কাটতে লাগল। রাহেলা আমার পাশেই থাকে। হাঁটে, কথা বলে, হাসে।
রাহেলা আমার সামনে বসে বই পড়ছিল। ওর মুখটা কেমন মায়াবী দেখাচ্ছে।

ঘরের ডিম লাইটের আলোয় ওর মুখটা আরো রহস্যময় লাগছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “রাহেলা, তুমি কি সত্যি আছো?”
রাহেলা বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। ওর চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করছে।
“কেন নয়?”
“তুমি কি জানো তোমার কী হয়েছিল?”
রাহেলা হাসল। সেই হাসিটা আমার বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরিয়ে দিল।
“আমি তো ভালো আছি।”
আমি চিৎকার করে উঠলাম, “না, তুমি ভালো নেই! তুমি ভালো থাকতে পারো না!”
আমার গলা চিঁড়ে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল।
আমার চিৎকার শুনে রাহেলা উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এল। ওর চোখ দুটো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। আমি ওর চোখে চোখ রাখতে পারছিলাম না। কেমন একটা আতঙ্ক আমাকে ঘিরে ধরল।
“তুমি আমাকে কেন দেখতে পাচ্ছো?” রাহেলা ফিসফিস করে বলল। ওর গলার স্বর শুনে মনে হলো, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে।
আমি চমকে উঠলাম। “মানে?”
“তুমিই তো আমাকে মুক্তি দিয়েছিলে।” রাহেলা হাসল।
ওর হাসিটা যেন চারপাশের বাতাসকে আরও শীতল করে দিল। ঘরের মিষ্টি-পচা ফুলের গন্ধটা যেন আরও তীব্র হলো। “আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। তুমি আর সহ্য করতে পারোনি। তাই না?”
আমার মনে পড়ল। সেই রাতের কথা। রাহেলার কষ্ট। আমার অসহায়তা। আমার হাত দুটো কাঁপতে শুরু করল। শরীরটা যেন অবশ হয়ে এল। আমার সামনে রাহেলার আবছা অবয়বটা কাঁপছে। রাহেলার মুখটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেই রাতে ওর মুখটা যেমন ছিল, তেমনই। চোখ দুটো বন্ধ। একটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। আমার মনে পড়ল, আমিই ওকে বালিশ চাপা দিয়েছিলাম। ওর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে।

আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে গেল। কাঁচ ভাঙার শব্দে বারান্দার নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। আমি চিৎকার করে উঠলাম। কারণ, আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাহেলা ততক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। শুধু থেকে গেছে ওর হিমশীতল স্পর্শ আর আমার মাথার ভেতর সেই রাতটা।
আহ! যন্ত্রণা। অসীম যন্ত্রণা।
-©️ Suchandra Das
#suchandraofficial